Home বিশ্লেষন বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার অনুভূতি

বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার অনুভূতি

আমার শৈশব কেটেছে মামার বাড়ি পাইস্কা বাসুন্দা গ্রামে। এ স্থানটি তত্কালে ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ মহকুমার রূপগঞ্জ থানার আওতাধীন ভোলাব ইউনিয়নে অবস্থিত। শৈশবে পাঠ্যবই পড়ে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কায়েদে আজম মুহম্মদ আলি জিন্নাহ, লিয়াকত আলি, গোলাম মুহাম্মদ, চৌধুরী মুহাম্মদ আলি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন, আযম খান ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নাম জেনেছি। রেডিও পাকিস্তানের প্রতিদিনের খবরে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ও তার মন্ত্রীদের নাম জানা যেত। আরেকজনের নামের সঙ্গে শৈশবে বেশ পরিচিত ছিলাম, তিনি হচ্ছেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনেম খান। রেডিওতে তত্কালে প্রেসিডেন্ট মাসের প্রথম দিন বেতার ভাষণ দিতেন। গভর্নর মোনেম খানের ভাষণও শোনা যেত। সম্ভবত ১৯৬৪ সালের শেষ দিকে এবং ১৯৬৫ সালের প্রথম দিকে দেশে যথাক্রমে ইউনিয়ন কাউন্সিল ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। ‘বেসিক ডেমোক্রেসি’ (বিডি) বা বুনিয়াদি গণতন্ত্রের অধীনে তত্কালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটার ছিলেন ইউনিয়ন কাউন্সিলে নির্বাচিত মেম্বাররা। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল আইয়ুব খান পুনরায় প্রার্থী হলেন। বিরোধী দল থেকে প্রার্থী দেয়া হলো মাদারে মিল্লাত ফাতেমা জিন্নাহকে। তিনি ছিলেন কায়দে আজম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর বোন। বড়দের মুখে শুনতাম পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনী সফর ও জনসভায় ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে থাকতেন আওয়ামী লীগ নেতা ও অনলবর্ষী বক্তা শেখ মুজিবুর রহমান। কথিত আছে জেনারেল আইয়ুব খান বিডি মেম্বারদের ‘উপঢৌকন’ দিয়ে স্বপক্ষে টেনে নেন এবং নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যখন ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন তখন আমি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। শেখ মুজিবুরকে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে গ্রেফতার করা হয়, তখন তার মুক্তির জন্য সারা পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন ও মিছিল-মিটি হয়। সেই সুবাদে তার নামের সঙ্গে বেশি পরিচিত হই। বিশেষ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এলাকার কয়েকজন ছাত্র আমাদের স্কুলে এসে ওপরের ক্লাসের ছাত্রদের আন্দোলনের কথা বলতেন।

১৯৬৮-৬৯ সালে আমাদের স্কুলেও মিছিল, হরতাল, ক্লাস বর্জন ইত্যাদি চলতে থাকে। সেসব মিছিলের স্লোগান ছিল—আইয়ুব শাহীর পতন হোক, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল করো, শেখ মুজিবুরের মুক্তি চাই, জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব ইত্যাদি। এসব আন্দোলনে বড়দের মুখে শুনতাম—আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের সোনালি আঁশ পাট বিক্রির টাকা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি, ইসলামাবাদে বড় বড় প্রাসাদোপম অট্টালিকা হচ্ছে, রাস্তাঘাট হচ্ছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আরো অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা শোনা যেত।

১৯৬৮-এর শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলন তীব্রতর করে। এটি ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতেই গণআন্দোলনে রূপলাভ করে। কয়েকটি ঘটনা তত্কালীন শাসকগোষ্ঠীর মসনদ টালমাটাল করে দেয়। ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানকে মিছিলে পুলিশের গুলি করে হত্যা, ২১ জানুয়ারি সচিবালয়ের দক্ষিণ পার্শ্বে নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিয়ারকে পুলিশের গুলি করে হত্যা এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালিয়ে শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা। অবশ্য এ গণআন্দোলনে সারা দেশে আরো বহু লোক নিহত হয়।

অবশেষে পাকিস্তান সরকার নমনীয় হয়। এরই মধ্যে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক সংবর্ধনার আয়োজন করে। রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল সমাবেশে তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সম্মিলিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধু উপাধিটি ঘোষণা করেন। পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলন, দাবিদাওয়া ও অবাধ নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে লাহোরে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। আন্দোলন তখনো থামেনি। তীব্র আন্দোলনের মুখে মার্চে জেনারেল আইয়ুব খান সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেন। পুনরায় সামরিক শাসন জারি করা হয়। তবে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন দেয়ার কথা বলেন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকদের মধ্যে মওলানা ভাসানী, কমরেড মনি সিং, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ প্রমুখও স্বাধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই পূর্ব পাকিস্তানের তথা পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পরিগণিত হন। আন্দোলনে আওয়ামী লীগে তার সহযোগী ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এএইচ এম কামরুজ্জামান, আব্দুল মালেক উকিল, জহুর আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ। ছাত্রনেতাদের মধ্যে যারা গণআন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন, তাদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখের নাম বেশি শোনা যেত। গণআন্দোলন শেষে জেনারেল আইয়ুব খানের শাসনের অবসান হলেও ছয় দফা ও ১১ দফা ভিত্তিতে স্বাধিকার আন্দোলন ও জনগণের দাবি আদায়ের আন্দোলন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুির রহমানের নেতৃত্বে অব্যাহত থাকে।

১৯৭০ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায়। অবশেষে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ও ১৭ ডিসেম্বর যথাক্রমে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়। আলাপ-আলোচনা ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে ১৩ জন নারী প্রতিনিধিসহ ৩১৩ আসনের পার্লামেন্টে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়ে ১৬২+৭=১৬৯টি আসন। কিন্তু ১২ নভেম্বর প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও বঙ্গোপসাগরে জলোচ্ছ্বাসে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সংলগ্ন উপকূলীয় দ্বীপ, যেমন হাতিয়া, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী ইত্যাদিতে প্রায় ১২ লাখ লোক মারা যায়। ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দাবি ওঠে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যথাসময়ে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায়। অবশেষে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৭০ সালে আমি দাউদপুর পুটিনা হাইস্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। এলাকার ছাত্রনেতাদের মধ্যে মফিজুর রহমান ও মোকলেছুর রহমান সুপরিচিত ছিলেন। মফিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থেকে দীর্ঘদিন কারাবাস করেছেন। তারা বিভিন্ন স্কুল-কলেজে এসে ছাত্রদের মাঝে বক্তৃতা করতেন। এছাড়া রূপগঞ্জ, কালিগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকায় জনসভা হলে সেখানে কাপাসিয়ার তাজউদ্দীন আহমদ এবং কালিগঞ্জের ময়েজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন প্রধান আকর্ষণ। ওই সময় জাতীয় ও ছাত্রনেতারা ইস্ত্রি করা ঢোলা পাজামা ও পাঞ্জাবি পরতেন। অনেকে পাঞ্জাবির ওপর মুজিব কোট পরতেন। আমরা আগ্রহভরে এসব নেতাকে দেখতে যেতাম।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনেই প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। তাজউদ্দীন আহমদ কাপাসিয়া-কালিগঞ্জে জাতীয় পরিষদে প্রার্থী মনোনীত হন। রূপগঞ্জ-নরসিংদী আসনে নমিনেশন পান আবদুর রাজ্জাক। তিনি রাজনীতিতে খুব সুপরিচিত ছিলেন না। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে কাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ রূপগঞ্জে, ময়েজউদ্দিন আহমেদ কালিগঞ্জে এবং মোসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া নরসিংদীতে মনোনয়ন পান।

নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা তখন তুঙ্গে। আওয়ামী লীগ নৌকা মার্কা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) কুঁড়েঘর, ন্যাপ (ভাসানী) ধানের শীষ ও জামাতে ইসলাম দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে নামে। পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রতীক ছিল সাইকেল আর নূরুল আমিনের পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতীক ছিল ছাতা। অবস্থাদৃষ্টে নৌকা প্রতীকের প্রতিই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার আগ্রহ লক্ষ করা যায়।

সত্তরের নির্বাচন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জীবন-মরণ যুদ্ধ। এ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে আওয়ামী লীগের পুনরায় সরকার গঠনের সুযোগ আসবে। সেজন্য কেন্দ্রীয় নেতারা বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব আসনের নির্বাচনী জনসভায় যোগদান করতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও রাত-দিন গণসংযোগ ও জনসভায় অংশগ্রহণ করেন।

নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে (সম্ভবত নভেম্বরের শেষ দিকে) কালিগঞ্জে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। উদ্দেশ্য, এ এলাকার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট প্রচারণা। জানা গেল ওই জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা করবেন। এলাকার জনগণ বঙ্গবন্ধুকে স্বচক্ষে দেখার জন্য উদগ্রীব। ঠিক করা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকার নিকটস্থ ডেমরা থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে একটি লঞ্চে করে কালিগঞ্জে আসবেন। পথিমধ্যে দু-তিন জায়গায় লঞ্চঘাটে জমায়েত জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা করবেন। আমার মামার বাড়ির সন্নিকটে আতলাপুর বাজারেও লঞ্চ থামবে বলে শোনা যায়। বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য এলাকার বহুলোক জমায়েত হয়েছে। আমিও বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধবসহ দীর্ঘক্ষণ ধরে লঞ্চের জন্য অপেক্ষমাণ। অবশেষে নির্ধারিত সময়ের বেশ খানিকটা পর প্রায় ৪টার দিকে লঞ্চ দেখা গেল। বিলম্বের কারণ হলো কিছু অনির্ধারিত ঘাটেও লঞ্চ থামাতে হয়েছে। লঞ্চ থামছে না দেখে কয়েকটি ঘাটে জনতার একাংশ নদীতে ঝাঁপ দিয়ে লঞ্চের দিকে যেতে থাকে। এ অবস্থায় লঞ্চ না থামিয়ে উপায় নেই। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য জনসাধারণের যে আগ্রহ ও আবেগ, তার মূল্য দিতেই হয়। ঘাটে লঞ্চ আসার পর প্রথমে আব্দুর রাজ্জাক কেবিন থেকে বের হয়ে আসেন। উত্সুক জনতা শেখ মুজিবুরকে দেখার জন্য তাকে অনুরোধ করেন। আব্দুর রাজ্জাক সাহেব পুনরায় কেবিনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসেন। বিভিন্ন স্থানে লঞ্চ থামিয়ে থামিয়ে নিয়ে আসায় কালিগঞ্জ জনসভায় পৌঁছতে বিলম্ব হবে। সেজন্য বঙ্গবন্ধু বেশ বিরক্ত হয়েছেন। কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে তিনি আব্দুর রাজ্জাক সাহেবকে ধমক দিলেন, তারপর উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘ভাইসব, আমাকে মাফ করবেন, আমার জনসভার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। আমি অন্য সময় আপনাদের কাছে আবার আসব। আপনারা সবাই নৌকা মার্কায় ভোট দিবেন। আমাদের নির্বাচনে জয়লাভ করতে হবে। জনগণের দাবি আদায় করতে হবে। আসসালামু আলাইকুম।’ সম্ভবত এ ধরনের কয়েকটি কথা ২ মিনিটের মধ্যে বলে তিনি লঞ্চের কেবিনে ঢুকে পড়লে লঞ্চ ছেড়ে দেয়।

সেদিন লঞ্চঘাটে আমি লঞ্চের খুব কাছাকাছি ছিলাম। সেজন্য বঙ্গবন্ধু যখন কেবিন থেকে বের হয়ে লঞ্চের সামনের দিকে দাঁড়ান তখন খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়। তার চেহারা, গায়ের রঙ, দৈর্ঘ্য, পোশাক-আশাক আমার কল্পনার চেয়ে অনেক সুন্দর, দীপ্তিময় মনে হয়েছে। ক্লিনসেভ করা, নাকের নিচে পরিপাটি গোঁফ, চোখে চশমা, গায়ে ইস্ত্রি করা সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি ও কালো মুজিব কোট। দীর্ঘকায় ও বলিষ্ঠ। পৌরুষে কোনো সংকোচ বা খুঁত নেই। দেখলেই একটা তীব্র আকর্ষণ অনুভূত হয়।

লঞ্চ ছেড়ে দিলে ছাত্র ও যুবকদের অনেকেই লঞ্চের পিছু পিছু কালিগঞ্জের উদ্দেশে দৌড় দেয়। বোঝা গেল জনসভার উদ্দেশ্যে নয়, শেখ মুজিবুরকে ২ মিনিট দেখে তৃপ্তি হয়নি, আরো দেখার জন্য, তার কথা শোনার জন্য কালিগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা। সবার সঙ্গে আমিও দৌড় দিলাম।

আতলাপুর বাজার থেকে কালিগঞ্জ পাইলট স্কুল মাঠের দূরত্ব প্রায় ছয়-সাত কিলোমিটার হবে। তার ওপর আবার নদী পার হতে হবে। আমরা দৌড়ে গুদারা (নদী পার হওয়ার জন্য বড় নৌকা) ঘাটে গিয়ে গুদারায় উঠলাম। মাঝিকে তাড়াতাড়ি নৌকা বাইতে বললাম। আমাদের আর তর সইছে না। নদী পার হয়ে কিঞ্চিৎ হেঁটে, বেশির ভাগ রাস্তা দৌড়ে কালিগঞ্জ পৌঁছে দেখা গেল অন্য নেতাদের বক্তৃতা শেষে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিচ্ছেন। আমরা ১৫ মিনিটের মতো তার ভাষণ শুনতে পেরেছিলাম। ভাষণ শোনার চেয়ে তাকে দেখার আগ্রহ ও কৌতূহলই ছিল বেশি। তবে জনসভার মাঠে তাকে অনেক দূর থেকে দেখতে হয়েছে।

সরাসরি জনসভায় না এসে আতলাপুর লঞ্চঘাটে অপেক্ষা করার সুবিধা ছিল, তাকে খুব কাছ থেকে দেখা সম্ভব হয়েছে। সংবাদপত্রে সাদা-কালো ছবিতে বঙ্গবন্ধুকে যেরূপ মনে হতো, বাস্তবে তাকে অনেক ফর্সা, বলিষ্ঠ এবং হ্যান্ডসাম সুপুরুষ মনে হয়েছে। চলাফেরা, পোশাক, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদিতে তার প্রতি যে তীব্র আকর্ষণ অনুভব করি, তা সারা জীবন লালিত হচ্ছে।

লেখক: মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সরকারের সাবেক সিনিয়র সচিব, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত