সেদিন এক স্যার বলছিলেন, সকালে গেলাম চোখের ডাক্তারের কাছে। ডাকসাইটে আই স্পেশালিস্ট। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সাক্ষাৎ পেলাম। সমস্যা বলা শুরু করতেই জানালেন, এ চিকিৎসা তিনি করতে পারবেন না! ঘাবড়ে গেলাম; ভাবলাম দুরারোগ্য ব্যাধিতে বুঝি আক্রান্ত হয়েছি। শেষমেশ জানা গেল, তিনি বাম চোখের বিশেষজ্ঞ। ফলে ডান চোখের চিকিৎসা করতে পারবেন না!
ঘটনাটি কল্পিত। তবে বাস্তবতা খুব একটা কমও যায় না। আগে ‘রক্ত পরীক্ষা’ বলতে আমরা একই জিনিস বুঝতাম। এখন নাকি (সেদিন টকশোতে শুনলাম) রক্তের ২৪০ প্রকারের টেস্ট হয়! ফলে একজন ডাক্তার সব ধরনের রক্ত পরীক্ষার ফলাফল বুঝতে পারবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। এ তথ্যগুলো দ্বারা বলতে চাইছি যে এখনকার দিনে আমরা যাই করি না কেন, ফোকাস হতে হবে সুস্পষ্ট।
মাঝেমধ্যে খুবই বিস্ময় জাগে। পৃথিবীতে ৭০০ কোটির উপরে মানুষ। অপ্রত্যাশিত মৃত্যু না হলে মোটামুটি সবাই ৭০-৮০ বছরের আয়ু লাভ করে। আবার সবাই যে জন্মের পরে অনুকূল পরিবেশ পায় তাও না। তার পরও ছোট্ট এই জীবনে অনেকেই এমন অর্জন করতে সক্ষম হয় যে গোটা দুনিয়া তাদের এক নামে চিনতে পারে! স্টিভ জবস তো বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫৬ বছর। জর্জ অরওয়েল ৪৬, সুকুমার রায় ৩৬ আর সুকান্ত ২১! তার পরও নানা পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাদের স্মরণ করি। এমন শক্তিশালী ব্র্যান্ড গড়ে ওঠা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়।
পণ্য বা কোম্পানির ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ সময় মেলে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম কিংবা অসংখ্য দক্ষ সিইও, ব্র্যান্ড ম্যানেজার মিলে সেটার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেই। খ্যাতিমান সব কোম্পানির মদের বোতলে তো সগর্বে লেখা হয় যে কয়শ বছর ধরে ওই ব্র্যান্ড জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। ইলেকট্রনিকস ও ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রেও এখন আমরা দেড়-দুইশ বছরের পুরনো অনেক প্রতিষ্ঠান দেখি। তাছাড়া পণ্যের আকর্ষণীয় নাম, লোগো, কালার, প্রতিষ্ঠানের ইমেজ, কাঁচামালের উেসর সুনামও ফিনিশড প্রডাক্টে যুক্ত হয়।
কিন্তু একজন ব্যক্তি জীবনে সফল হওয়ার পরে হয়তো অনুভব করেন যে নিজেকে ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা দরকার। অবশ্য এক্ষেত্রে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তারা কি সচেতনভাবে তেমন চেষ্টা করেন? নাকি নিজেদের কাজে সেরা হওয়ার ফলেই তাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে? খুব সম্ভবত তারা কেউই নিজেকে ব্র্যান্ডিং করার লক্ষ্যে কাজ করেননি; বরং নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে তারা এক্সেল হতে সচেষ্ট ছিলেন। দীর্ঘকাল চারপাশের মানুষগুলো হয়তো তাদের পাত্তাই দেয়নি। একসময় তাদের কাজ কথা বলেছে!
স্টিভ জবস, জ্যাক মা, অপরাহ উইনফ্রে জীবনের বড় একটা অংশ নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য স্ট্রাগল করেছেন। জীবনের এক পর্যায়ে (শুধু নিজের নয়) মানবসমাজের একটা বড় গোষ্ঠীর জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছেন। এপিজে আব্দুল কালাম এমন জায়গা থেকে উঠে এসেছেন, যেখানকার ছেলেমেয়েরা তখনকার দিনে হাই স্কুলে পড়ার স্বপ্নও দেখত না! অথচ তিনি হয়েছেন শীর্ষস্থানীয় মহাকাশ বিজ্ঞানী, অলংকৃত করেছেন ভারতের মতো বিশাল দেশের রাষ্ট্রপতির আসন।
কবি হরিশ্চন্দ্র মিত্র লিখেছেন, ‘লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয়।’ অর্থাৎ তখনকার দিনে গুণী লোকেরা নিজের ঢোল নিজে পেটাতেন না। কিন্তু এখন দিন বদলে গেছে। ফেসবুকে আমার সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ মেয়েই নিজেকে ‘মডেল’ আর ছেলেরা নিজেদের ‘হিরো’ মনে করে! বিশ্বাস না হলে আপনার ফেসবুক স্টোরি একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করুন।
আত্মপ্রচারণার এ যুগে অন্যের ঢোল পেটানোর মতো লোক পাওয়া দুষ্কর। তাছাড়া নিন্দুকেরা বলে, অন্যকে বাজাতে দিলে তারা ঢোলটা ফাটিয়েও ফেলতে পারে। তাই অধিকাংশ ব্যক্তি এখন নিজেই সেটা পেটানো নিরাপদ মনে করছেন। তাছাড়া চারপাশে এত বেশি মানুষ মনোযোগের কাঙাল হয়েছে যে সিংহভাগই আত্মপ্রচারে মগ্ন।
এখন কথা হলো আপনার সত্যিই সেদিকে বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া দরকার কিনা? জবাবটা অন্যভাবে দিই। মনে করুন, আপনি একজন মিষ্টি ব্যবসায়ী। এখন প্রচারের যুগ, তাই সারা দিন আপনি মিষ্টির প্রচারে মনোযোগী থাকলেন। অথচ পণ্য প্রস্তুত-বণ্টন-মূল্য নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে থাকলেন চরম উদাসীন। তাহলে ওই প্রচার কি দীর্ঘমেয়াদে আপনার মিষ্টির ব্যবসার প্রসারে সাহায্য করবে?
অবশ্যই না। কারণ প্রথমে আপনার পণ্যের গুণগত মান, তার পরে তা যথাযথভাবে প্রত্যাশিত দামে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেবে। আপনি যতই প্রচার চালান না কেন, তাদের আপনার দোকানের ত্রি-সীমানায় আনতে পারবেন না।
ব্যক্তির ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও বিষয়টা তেমনই। প্রথম শর্ত হলো, আপনার নির্ধারিত কাজে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সে বিষয়ে আপনি অনন্য হলে ক্রমে আপনার সুনাম ছড়াতে থাকবে। ধীরে ধীরে বড় গোষ্ঠীর কাছে আপনি পরিচিত ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবেন বলে আশা করা যায়। এক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। তার উৎপাদিত পণ্যের জন্য আলাদাভাবে প্রমোশনাল ইফোর্ট (খুব একটা) ইনভেস্ট করতে হতো না।
পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে তিনি এমন সব বৈশিষ্ট্য যুক্ত করতেন যে প্রত্যেক দর্শক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তার উপন্যাস, নাটক, সিনেমা নিজে উপভোগ করত এবং অন্যদের কাছে প্রচার করত। তবে হ্যাঁ, সবাই তার মতো প্রতিভা নিয়ে জন্মায় না। ফলে ব্র্যান্ডিং বিষয়ে অগ্রসর হতে হবে। তবে সেটা সচেতনতার সঙ্গে। হঠাৎ ঝাঁপিয়ে না পড়ে, দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে—আপনার কাজের প্রচার করবেন, নিজের নয়।
আমার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই দিনে চৌদ্দবার করে চিৎ-কাৎ, ব্যাঁকা-ত্যাড়া হয়ে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে আর ভাবে, তার ব্র্যান্ড ইমেজ বুঝি খুব বাড়ছে! তারা জানে না যে এমন কার্যক্রমে অধিকাংশ মানুষ বিরক্ত। চক্ষুলজ্জায় আনফ্রেন্ড না করলেও তাকে আনফলো করে রাখে। কারণ শুধু ওই ‘চাঁদবদন’ কয়বার দেখতে ভালো লাগে? এতে সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি হয়। হয়তো সে কারণেই বন্ধু তালিকায় চার হাজারজনের বেশি থাকার পরেও একটা পোস্টে ৪০টা লাইক জোটে না!
অন্যদের কাছে আপনার কেন গ্রহণযোগ্য হওয়া দরকার, সে ব্যাপারে স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা জরুরি। তাছাড়া সাধারণ মানুষ কেন আপনাকে গ্রহণ করবে, তারও কারণ থাকতে হবে। সেগুলো বিশ্লেষণ করে নিউজ ভ্যালু আছে বা পাবলিক সত্যিই আগ্রহী—এমন বিষয়ে যুক্ত হতে চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে তেমন ইভেন্ট ক্রিয়েট করুন। সেখানে দক্ষতার সঙ্গে নিজের অবদান ও সংশ্লিষ্টতা তুলে ধরতে থাকুন। এতে ধীরে ধীরে আপনার গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। নইলে বেশি প্রচারের ঠেলায় লোকেরা একসময় আপনাকে এড়িয়ে চলবে।
ধরা যাক, আপনি একজন শিক্ষক। ক্লাসরুমে পড়ানো আপনার দৈনন্দিন কাজ। তা আবার ছবি তুলে জাতিকে জানানোর কী আছে? আপনি খুব যত্ন করে ক্লাসরুমে পড়ালেও তার কোনো নিউজ ভ্যালু নেই। অথচ আপনি যদি কোনো সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাদের বিশেষ কোনো কার্যক্রমের ব্যাপারে স্ট্যাটাস দেন, অন্তত কিছু মানুষ আগ্রহী হবে। তাই রেগুলার কাজের বাইরে বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিন। তবে তা যেন শুধু লোক দেখানো না হয়। অল্প কিছু মানুষের জীবনে হলেও যেন ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
নিজেকে ব্র্যান্ডিং করার লক্ষ্যে অনেকেই ‘ভাইরাল’ হতে চেষ্টা করেন। এমন ঘটনা আপনাকে ক্ষেত্রবিশেষে ফেভার করতে পারে। তবে সেটার জন্য চেষ্টা করা মোটেই কাজের কথা নয়। বরং নিরলসভাবে নিজের কর্মক্ষেত্রে অনন্য হতে সচেষ্ট হোন। অন্তত ক্যারিয়ারের শুরুতে এমন ভাইরাল না হওয়াই কল্যাণকর। যেমন কিছুদিন আগে আলোচনায় আসা শিশু বক্তাদের কথা ভাবুন। টয়লেট করার পরে যারা একা একা পরিচ্ছন্ন হওয়া শেখেনি, তাদের ভাইরাল করে অন্যরা সাময়িক সুবিধা পেলেও ক্ষতি হয়েছে তাদের। কয়েক দিন অনলাইনে হাইপ তুলে তারপর ফানুসের মতো চুপসে গেছে।
কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ ঠিক কোন কারণে প্রবল হয়, তা এককথায় বলা মুশকিল। বরং প্রতিটি ঘটনায় বিশেষ এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ফলে বিশেষ ব্যক্তি বা ঘটনা তুমুলভাবে আলোচ্য হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে গত ছয় মাসে ভাইরাল হওয়া ঘটনাগুলো স্মরণ করতে চেষ্টা করুন। ঠিক কোন কারণে সাধারণ মানুষের কাছে সেগুলো গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, তা মোটেই স্পষ্ট নয়। খুব সাধারণ একটা কথাও মাঝেমধ্যে ব্যাপক ভাইরাল হয়ে যায়। যেমন ‘পরিবেশটা সুন্দর না’ কিংবা ‘ওরে বাটপার!’
দৈনন্দিন জীবনে এর চেয়ে অনেক বেশি ‘চিত্তাকর্ষক বাক্য’ আমরা অহরহ শুনি। কিন্তু সোস্যাল মিডিয়া ঠিক কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে ওপরের কথা দুটো পিক করেছে, তা স্পষ্ট নয়। আবার ধরা যাক ‘…খেলা হবে’ এমন কথা রাজনীতির মঞ্চে অহরহ বলা হয়। কিন্তু ছোট্ট এই কথাটা কেন মানুষের মনে ধরল, তা সত্যিই দুর্বোধ্য। তবে কারণ যা-ই হোক, মানুষ সেটা পিক করেছে। ফলে তা মুখে মুখে ভাসছে। একথাগুলো বক্তারা যে খুব ভেবেচিন্তে বলেছেন, তেমনটা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
তাই ভাইরালের ভাইরাস যেন আপনার শরীর ও মনে বাসা বাঁধতে না পারে, সে ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকুন। দুনিয়ার কোনো খ্যাতিমান ব্যক্তি মিডিয়া কাভারেজ পাওয়ার জন্য কাজ করেননি। নিজ কাজে অনন্য হওয়ার পরে মিডিয়া তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
হাল আমলে এক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো, আগে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করত অন্যরা। ফলে তাদের মনোযোগ আকর্ষণে সফলতার গড় মাত্রার চেয়েও উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছতে হতো। আর এখন প্রত্যেকের হাতে ক্যামেরা ও চ্যানেল (ফেসবুক লাইভ, ইউটিউব চ্যানেল প্রভৃতি) থাকায় অনেকেই কাজের চেয়ে প্রচারে বেশি মনোযোগী হচ্ছেন। এর মাধ্যমে সাময়িক হাইপ সৃষ্টি করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদে কিন্তু টিকে থাকা যাবে না!
মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘মস্তিষ্কের মালিকানা’ বইয়ের লেখক