শামসুন্নাহার বেগম। পেশায় ছোট খামারি। বসবাস করেন গাজীপুরের কাউলতিয়া মধ্যপাড়ায় । শীতের সময়, অর্থাৎ তিন থেকে চার মাস তাঁর খামারে মুরগি থাকে দেড় থেকে দুই হাজার। বাকি সময়টায় মুরগির সংখ্যা থাকে ৯০০ থেকে ১ হাজার। এক হাজারের নিচে মুরগি থাকায় সরকারী স্বীকৃতি পায়নি শামসুন্নাহার।
শামসুন্নাহারের স্বামী একটি সোয়েটার কারখানায় কাজ করেন। স্বামী, এক সন্তান ও মাকে নিয়ে তার সংসার। ছোট খামারটি ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনাকালে অন্তত ৭০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি এখনো পোষাতে পারেননি। এক হাজারের কম মুরগির এসব ছোট খামারের সাধারণত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিবন্ধন থাকে না। তাঁরও নেই। আর তা না থাকায় করোনাকালে সরকারি প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
করোনাকালের এ বিঘ্ন এখন কিছুটা কাটলেও, তাঁর মতো খামারিদের সার্বক্ষণিক সমস্যাগুলো রয়েই গেছে। বড় প্রতিবন্ধকতা হলো বাজারজাতকরণ। তিনি মুরগি বিক্রি করেন ডিলারের কাছে। যে ডিলার খাদ্য ও বাচ্চা সরবরাহ করেন, তাঁর কাছেই মুরগি বিক্রি করতে হয়।
শামসুন্নাহার বলছিলেন, ‘বাজার বুঝবার পারি না। হেরা (ডিলার) যা কয়, তার ওপরই বিশ্বাস যাইতে হয়। খালি শুনি বাজার খারাপ। ডিলারদের কাছে আমরা একপ্রকার বন্দী। ’
বাজারজাতকরণ, ঋণপ্রাপ্তি নানা সমস্যার পরও দেশের নারীরা পোলট্রি খাতে অবদান রেখে চলেছেন। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের পোলট্রি খাতে দেশের প্রায় ৬০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত। এর মধ্যে ৪০ শতাংশই নারী। তবে জাতীয় পর্যায়ে বা সরকারি স্তরে এ-সংক্রান্ত কোনো উপাত্ত নেই।
প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ এ এইচ এম তাসলিমা আক্তার বলেন, পোলট্রি খাতে নারীর অবদানের স্বীকৃতি জাতীয় পর্যায়ে থাকা উচিত। সরকারের পোলট্রি নীতি, প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন নীতিমালায় সুনির্দিষ্টভাবে নারীদের তুলে ধরে কিছু বলা নেই। এসব অস্বীকৃতি তাদের অবদানকে অস্বীকার করারই নামান্তর।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ২০৫৭ দশমিক ৬৪ কোটি। এর আগের অর্থবছরেই ডিমের উৎপাদন ৩০০ কোটির কম ছিল। করোনাকালে দেশে ডিমের উৎপাদন বেড়েছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু ডিম প্রাপ্যতার সংখ্যাও প্রতিবছর বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জনপ্রতি বছরে ডিম লাগত ৯২ দশমিক ৭৫টি। ২০২০-২১ অর্থবছরে এটি দাঁড়িয়েছে ১২১ দশমিক ১৮টি।
তাসলিমা আক্তার বলেন, পোলট্রি খাতের এই উন্নয়নে নারীদের বড় অবদান আছে। কিছু বড় খামারি বাদ দিলে ৮০ হাজারের বেশি খামারে ১ হাজার থেকে ৩ হাজারের নিচে মুরগির পালন করা হয়। এখানে নারীরাই বেশি। এক হাজারের নিচে মুরগি আছে, তারা নিবন্ধিত খামারি নন। সেই সুযোগও নেই।
২০১৯ সালে ‘পার্টিসিপেশন অব উইমেন ইন কমার্শিয়াল পোলট্রি ফার্মস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, ৪৭ শতাংশ খামারের আকারই ছোট। অর্থাৎ, এক হাজারের কম মুরগি। আর ৪৫ শতাংশ মাঝারি। বাকিগুলো বড়। আর ছোট ও মাঝারি খামারিদের মধ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিবন্ধন রয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ খামারির। ৪৭ শতাংশ খামারই গড়ে উঠেছে অন্যের জমিতে। বীজ বিস্তার ফাউন্ডেশনের সহায়তায় উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ) এ জরিপ করে দেশের চার উপজেলায়। সেগুলো হলো চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ, রংপুর সদর, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার এবং কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায়।
পোলট্রি খাতের নানা ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। ওই জরিপেই দেখা যায়, খাবার দেওয়ার ক্ষেত্রে ৮৭, পানি খাওয়ানোর ক্ষেত্রে ৭০ ভাগ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে ৯৬ শতাংশ কাজই নারীদের করতে হয়।
এত কিছু করার পরও, ঋণপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণে নারীদের প্রতি বৈষম্য প্রবল বলে মনে করেন বিপিআইসিসির নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও আফতাব বহুমুখী ফার্মসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান। তিনি বলেন, ‘পোলট্রি খাতের মাধ্যমে নারীরা অর্থনৈতিক বিকাশে বিরাট অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু তাঁদের সেই অবদান স্বীকৃত নয়। পোলট্রি তাদের স্বাবলম্বী করে।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা বলেন, ‘পোলট্রি খাতে নারীদের অবদান অসামান্য। কিন্তু তাঁদের ছোট খামারের নিবন্ধনসহ বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। আমরা আমাদের কাজে সে বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
বিজনেস/এমআর