- পদ্মার চরে হাজার কোটি টাকার খনিজ মজুদ
- মেঘনার অববাহিকায় ম্যাগনেটাইটের মজুদরা যাবে
- যমুনার চরে রিউটাইল-ম্যাগনেটাইটের বিশাল মজুদ
‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা/ তোমার আমার ঠিকানা’ একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে এটি ছিল অন্যতম স্লোগান। তখন নদীতে ছিল মূলত মাছ। মাছে-ভাতে বাঙালির ঐতিহ্য রক্ষায় যুদ্ধজয়ের উদ্দীপনায় তৈরি হয়েছে এই স্লোগান। তবে আবহমানকাল ধরে বাঙালির জীবন ও কর্মের সঙ্গে মিশে থাকা নদী যে শুধু নৌপথ কিংবা মাছের উৎসই নয়, অফুরন্ত সম্পদেরও উৎস তখন হয়তো কেউ জানতেই না। তবে এখন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের অসংখ্য নদীর তলদেশের বালিতে লুকিয়ে রয়েছে মূল্যমাণ সব খনিজ সম্পদ। দীর্ঘদিন ধরেই চলছে এ বিষয়ে গবেষণা আর অনুসন্ধান।
নদ-নদী থেকে বছরে ২৫ কোটি টন খনিজ বালি সংগ্রহ সম্ভব। আয় হবে হাজার কোটি টাকার। বিমানের খুচরা যন্ত্রাংশের কাঁচামাল মিলবে দেশেই।
গবেষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের নদ-নদীর তলদেশের বালি পরীক্ষা করে মূল্যবান খনিজ সম্পদের অস্তিত্ব মিলছে। পাওয়া যাচ্ছে ইলমেনাইট, গার্নেট, জিরকন, রুটাইল এবং মেগনেটাইটের মতো খনিজ সম্পদ। যা দেশের অর্থনৈতিক চরিত্র পাল্টে দিতে সক্ষম। মূলত নদীতে পাওয়া এসব খনিজ সম্পদ প্রাকৃতিকভাবে সুনির্দিষ্ট রাসায়নিক গঠনবিশিষ্ট অজৈব পদার্থ। যা আসলে মণিক। আবার কয়লা ও খনিজ তেল জৈব উৎস থেকে উৎপন্ন হলেও এগুলোও মাণিক।
সূত্রমতে, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন (বিএসি) ২০১৯ সালের আগস্টে ৩৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘বাংলাদেশের নদীবক্ষের বালিতে মূল্যবান খনিজের উপস্থিতি’ নামে একটি প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করেছে। এর আওতায় ময়মনসিংহ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম এবং ভোলা জেলার নদী মোহনা এলাকায় জরিপ পরিচালিত হচ্ছে। আরো জরিপ চালানোর পাশাপাশি উপকূলীয় দ্বীপ এলাকার বালুতেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।
দেশের অন্যতম দুই বৃহৎ নদী পদ্মা ও মেঘনার বালিতেই শুধু খনিজ সম্পদের উপস্থিতি মিলছেন নয়, বরং ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা ও সোমেশ্বরী নদীর কিছু অঞ্চলেও ভারী ও হালকা খনিজের উপস্থিতি রয়েছে। এসব খনিজসম্পদ আহরণে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার। যৌথভাবে নদীর খনিজ সম্পদ আহরণে কাজ করবে দুদেশ। উত্তরের উপজেলা চিলমারী এলাকায় ইতোমধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের বালুতে তিন থেকে পাঁচ শতাংশ মূল্যবান খনিজ পদার্থ রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। পরীক্ষা করা হচ্ছে তিস্তা নদীর বালুর নমুনাও। সেখানে গার্নেটের পরিমাণ ১২ থেকে ১৮ শতাংশ। মূল্যবান এসব দ্রব্য পৃথকীকরণে জয়পুরহাটে ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারেলজি অ্যান্ড মেটালার্জি বিভাগ নামে একটি প্ল্যান্টও স্থাপন করা হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, নদী বা সাগরের উৎস থেকে সংগ্রহ করা খনিজ কণিকা কাঁচশিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। অন্যান্য খনিজগুলো পৃথক করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করলে রং, সিরামিকস, ইলেকট্রনিকশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের চাহিদা পূরণ করবে। এতে দেশেই সংগ্রহ করা যাবে সিরামিক, গাড়ি ও উড়োজাহাজসহ বিভিন্ন শিল্পের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির কাঁচামাল। তাতে কমবে বিদেশের প্রতি নির্ভরশীলতা।
ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারেলজি এন্ড মেটালার্জির (আইএমএমএম) পরিচালক ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ নাজিম জামান বলেন, আমাদের গবেষণা চলমান। আগামী দু’মাস লাগবে এটি গুছিয়ে আনতে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য আশাব্যঞ্জক। এখানকার দাবিতে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ ভারী খনিজপদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে ইলমেনাইট, গার্নেট, জিরকন, রুটাইল এবং মেগনেটাইট অন্যতম। ড. নাজিম আরো বলেন, রাষ্ট্রীয় এসব সম্পদ রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও স্থানীয় লোকজনের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। তা না হলে এটি পণ্ডশ্রমে দাঁড়াবে। দেশের সম্পদের মূল্য সবাইকে বুঝতে হবে।
গবেষকদের দেয়া তথ্যমতে, মেঘনা নদীর অববাহিকায় ঢেউয়ের বিস্তৃতে জমা হচ্ছে ম্যাগনেটাইটের মতো মূল্যবান ভারী খনিজ। যা সারা দুনিয়াজুড়ে বহুল ব্যবহৃত। আর এসব খনিজে আয়রন ও টাইটানিয়ামের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় বিশুদ্ধিকরণ ছাড়াই ইস্পাত কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারযোগ্য। যমুনার উপরিভাগের চরগুলোতে রিউটাইল ও ম্যাগনেটাইটের বিশাল মজুদ রয়েছে। যা আহরণে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে বা যৌথ মালিকানায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হলে এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার সম্ভব।
গত ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবেশ মুখ ও সন্নিহিত এলাকায় আইএমএমএমের জরিপের বিষয় উল্লেখ করে বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে প্রতি বছর ৭৩৫ থেকে ৮০০ মিলিয়ন টন পলি প্রবাহিত হয়। এর অন্তত এক তৃতীয়াংশ নদীর বুকে এবং এক তৃতীয়াংশ তীরবর্তী এলাকায় জমা হয়। বাকি এক তৃতীয়াংশ প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে হারিয়ে যায়। ব্রহ্মপুত্র থেকে বছরে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন টন খনিজসমৃদ্ধ বালু সংগ্রহ করা সম্ভব। নদটির প্রতি টন বালুর অন্তত অর্ধেক পরিমাণই কোয়ার্টজ। অর্থাৎ প্রতিটন বালু থেকে অন্তত ০.৫ টন কোয়ার্টজ সংগ্রহ করা যাবে। বছরে ২৫০ মিলিয়ন টন পলি উত্তোলন করা হলে তা থেকে অন্তত ১২৫ মিলিয়ন টন কোয়ার্টজ সংগ্রহ উপযোগী। এছাড়া প্রতি টন পলি হতে প্রায় ৬০০ গ্রাম ইলমিনাইট, ৪০০ গ্রাম জিরকন, ৪০০ গ্রাম রুটাইল, ২ কেজি ৫০০ গ্রাম গারনেট এবং ১০০ গ্রাম মোনাজাইট সংগ্রহ করা সম্ভব। কোয়ার্টজ কাঁচশিল্প ছাড়াও সোলার প্যানেলের সিলিকনের চিপ তৈরিসহ বিভিন্নকাজে ব্যবহার করা হয়।
বিজনেস/এম.আর